জামার্নিতে এসেছি প্রায় ছয় মাস হয়ে গেল। চোখের পলকে জীবনে একটা প্রত্যাশিত পরিবর্তন চলে এলো। আসার পথে বিমানে কয়েকবার কেঁদেছিলাম এই ভেবে যে “সবকিছু ফেলে আমি কোথায় চলে যাচ্ছি”! প্রিয় মানুষ, প্রিয় দেশ হতে ১০ হাজার কিলোমিটার দূরে থাকা অতটা সহজ নয়।এইখানে ঘুম ভাঙে পরীক্ষা-ল্যাব কিংবা অন্যান্য বহু টেনশনে, এইখানে মায়ের হাতের রান্না নেই, প্রিয় শহরের প্রাণবন্ততা নেই, টং-এর চা নেই, নেই ভাঙা রাস্তা আর গাড়ির ধোঁয়ার মাঝে একরাশ প্রশান্তি। এত নেই এর মাঝে শুধু আছে স্বপ্ন পূরণের তৃপ্তি। হয়ত এই তৃপ্তির জন্যই বর্তমানে বিদেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ আমার মত দেশের সিংহভাগ শিক্ষার্থীর স্বপ্ন!
স্বপ্ন হবে না কেন ? আমাদের দেশের মেধাবীরা যখন ছোট বেলা হতেই বুয়েট, মেডিক্যাল কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন লালন করে বড় হয় তখন আন্তর্জাতিক পরিসরে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থানও বেশ নাজুক। আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ ২০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও আমাদের স্বপ্নের বেশীরভাগ প্রতিষ্ঠানগুলো নেই; সম্প্র্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ ১০০০ -এ জায়গা করে নেয়া আনন্দদায়ক হলেও বাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্হান হতাশাজনক । আসলে এই Ranking দিয়ে কি বোঝায়? Ranking গুলো আসলে করা হয় মূলত বিশ্বদ্যালয়ের বিষয়ভিত্তিক মৌলিক গবেষনা এবং এই গবেষনার ফলাফল বিশ্বের অগ্রগতিতে কেমন ভুমিকা রাখছে তার উপর। অতএব Ranking এটিই বলে দিচ্ছে বৈশ্বয়িক অগ্রগতিতে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুমিকা বেশ নাজুক। এছাড়া পাশ করার পর চাকুরির টেনশনে অধিকাংশ গ্র্যাজুয়েটের মাথার চুল পড়ে যায়। সবকিছু মিলিয়ে নিজের যোগ্যতা বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহনযোগ্য পেশাগত দক্ষতা অর্জন, বিশ্ব সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী, দেশের কর্মক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাওয়া, সর্বোপরি নিজের জীবনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিদেশে পড়ে আসা বর্তমান ছাত্রদের অন্যতম প্রধান স্বপ্ন। তবে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীরা আসতে পারে না কারণ তারা মনে করে বিদেশে মাস্টার্স-পিএইচডি এইসব হলো অন্য গ্রহের এলিয়েন কিংবা অতীব মেধাবীর কাজ, ইহা তাদেরকে দিয়ে সম্ভব হবে না। কিন্তু ইহা সকলকে দিয়েই সম্ভব যদি ইচ্ছে এবং সঠিক দিকনির্দেশনায় অগ্রসর হওয়া যায়।
তবে যাব বললেই আসা যাবে না, প্রিয় মাতৃভুমি ছাড়ার আগে অনেক গুলো বিষয় বিবেচনা করতে হয়। যেমন, পছন্দের বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রহনযোগ্যতা, স্কলারশীপ, টিউশন ফি, গবেষনার সুযোগ, ভবিষ্যত চাকরির বাজার ,জীবন যাত্রার খরচ, আবহাওয়া,(ছবি পাগলরা সুন্দর সুন্দর ছবি তোলার স্হানও বিবেচনা করে) ইত্যাদি। সবকিছু বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া ও ইউরোপ ছাত্রদের পছন্দের জায়গা। একেক দেশে একেক রকম সুযোগ সুবিধা কিংবা অসুবিধা আছে । যেমন আমার ক্যার্লিফোনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি, USA তে প্রফেসর কনভিন্সড হয়েছিল ফান্ডিং সহ কিন্তু GRE দিতে হবে ভর্তির জন্য। আমি অলস প্রজাতির হওয়ায় এই পেইন নিতে পারি নি । আবার কানাডায় রিসার্চের সুযোগ হয়েছিল কিন্তু কবে নাগাদ আমাকে প্রফেসর নিতে পারবেন ঐটা নিশ্চিত করে বলতে পারছিলেন না। আমিও আর ধৈর্য্য ধরি নি জার্মানিতে সুযোগ পাওয়া মাত্র উড়াল দিলাম। তাই জার্মানিতে আসার বিভিন্ন দিক আমার অভিজ্ঞতার আলোকে তুলে ধরছি। সকল তথ্য ১০০% ধ্রুব নয়; স্হান, কাল , পাত্র ভেদে পরিবর্তিত হতে পারে ।
- কেন জার্মানি আসবেন ? একেক জনের কাছে জামার্নি একেক কারণে উত্তম। প্রথম কারণ হলো জার্মানির শিক্ষার মান । সাড়া পৃথিবীতেই জার্মান ডিগ্রীর কদর রয়েছে । বিশেষ করে বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষনার জন্য জার্মানিকে স্বর্গ বলা চলে, বিশ্ববিখ্যাত অনেক রিচার্স ইনস্ট্রিটিউটের জন্ম জামার্নিতেই। এ পর্যন্ত ১০৩ টি নোবেল জার্মানদের পকেটে ঢুকেছে যা বিশ্বে তৃতীয়। এছাড়া জার্মানির অন্যতম আকর্ষনীয় দিক হলো এখানে বেশীর ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি নেই । অর্থাৎ আপনি ফ্রিতে পড়তে পারবেন। এইখানে সামাজিক নিরাপত্তা বেশ ভালো । অর্থনৈতিক ভাবেও জার্মানি বেশ শক্তিশালী । ইউরোপের প্রথম ও বিশ্বের চতুর্থ পরাশক্তি হলো বর্তমানে এঙগেলা মারকেলের নেতৃত্বাধীন দেশটি । তাই পড়াশুনা শেষে স্হায়ী চাকুরী অথবা বসবাসের জন্য এই দেশটি খারাপ পছন্দ নয়। এছাড়া আরেকটি চমকপ্রদ বিষয় হলো এইখানকার স্টুডেন্ট ভিসা দিয়ে আপনি ইউরোপের ২৬টি দেশে গবেষনার সুযোগ তৈরী করতে পারবেন, সেই সাথে ইউরোপে ঘুড়াঘুড়ির সুযোগ তো আছেই। তাই সবকিছু মিলিয়ে ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে সহজে তৈরী করতে জার্মানিতে শকুন দৃষ্টি দিতে পারেন ।
- কি পড়তে পারবেন জার্মানিতে? মোটামুটি সবই পড়তে পারবেন এইখানে। জার্মানিতে ব্যাচেলর্স, মাস্টার্স, ডক্টোরাল ও পোস্ট-ডক্টোরাল ডিগ্রি দেওয়া হয়ে থাকে। এ ছাড়া ডিপ্লোমা করারও ব্যবস্থা রয়েছে। তবে আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো মাস্টার্স বা পি এইচ ডি’র দিকে নজর দেয়া। এছাড়া ইন্টারন্যশনাল প্রোগামগুলোতে পড়তে আসলে জার্মান ভাষায় পারদর্শীতা প্রয়োজনীয়তা নেই, ইংরেজীই যথেষ্ট। ২০১৬ সালে সবমিলিয়ে ১২৫৮ টি বিষয় অফার করা হচ্ছে যা সম্পূর্ণ ইংরেজীতে ; তন্মধ্যে ৯০ টি ব্যাচেলর্স, ৭২২ টি মাস্টার্স প্রোগাম উল্লেখযোগ্য (প্রতিবছরই বিষয়ের সংখ্যা বাড়ছে)। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বছরে দুটি সেমিস্টারে ভর্তির সুযোগ থাকে। গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্রীষ্মকালীন ও অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত শীতকালীন সেমিস্টার । গ্রীষ্মকালীন সেমিস্টারের জন্য আবেদন করতে হয় ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে এবং শীতকালীনের জন্য জুন-জুলাই মাসে । ব্যাচেলর্স ডিগ্রি তিন-চার বছর ও মাস্টার্স ডিগ্রি সমূহ সাধারণত দুই বছর মেয়াদি ; ফাকিঁবাজ হইলে আড়াই-তিন বছরও লাগতে পারে পাস করতে তবে অধিকতর ফাকিঁবাজ হইলে সোনার বাংলার টিকেট ধরায় দিবে । এবার সবচেয়ে দরকারী কথায় আসি অর্থাৎ কিভাবে জ্বালাবেন স্বপ্নের প্রদীপ ! আপনার কেমন যোগ্যতা থাকলে আপনি জার্মানির বুকে বাসা বাঁধতে পারেন সেটাই ব্যাখ্যা করব তবে আমি মাস্টার্সের বিষয়ে ফোকাস করছি ।।
১। বাইরে পড়তে আসার স্বপ্ন তদুপরি জামার্নিতে পড়তে আসার স্বপ্ন । ২। স্বপ্ন বাস্তবায়নে পরিশ্রম করার মানসিকতা । ৩। নিজে নিজে এপ্লাই করা হতে শুরু করে জার্মানিতে এসে রান্না করার মানসিকতা । ভুলেও ভাববেন না কিছু টাকা খরচ করে এজেন্সির মাধ্যমে চলে যাবো । এজেন্সির মাধ্যমে জার্মানি আসা প্রায় অসম্ভব । তাই নিজে কাগজ পত্র তৈরী করা হতে পুরো পথ পাড়ি দিতে প্রস্তুত হোন তবে কাজগুলো অতটা কঠিন কিছু নয়। ৪। শিক্ষাগত যোগ্যতা : আপনি ব্যাচেলরে আসতে চাইলে ১২ বছর ( অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩ বছর) শিক্ষা অভিজ্ঞতা লাগবে এবং মাস্টার্সের জন্য ব্যাচেলর ডিগ্রী। অনেকে মনে করেন সিজিপিএ ৪ অথবা ৩.৮ না পেলে বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে পারব না ! এই কথা সত্য হলে বোধ হয় আমার আসা হতো না । আসলে সিজিপিএ ৩.৫ পেলেই বেশ ভালো । তবে ৩ এর উপরে থাকলেই মোটামুটি সেইফ বলা যায় । ৩ এর নিচে থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে আসা সম্ভব যদি অন্যান্য যোগ্যতা সমূহকে বেশ শক্তিশালী করা যায় । এছাড়া বাংলাদেশে কোথায় পড়ছেন সেটাও ভাবার দরকার নাই কারণ ওনারা আমাদের পাবলিক-প্রাইভেট কিছুই চেনেন না। daad.de এই ওয়েবসাইটি জার্মানির উচ্চশিক্ষার বাইবেল। এই ওয়েবসাইটে গিয়ে আপনার পছন্দের বিষয় খুজেঁ নিতে পারেন অনায়াসে, সাবজেক্টের সাথে প্রয়োজনীয় বাকি সকল তথ্য যেমন আবেদনের প্রক্রিয়া,যোগ্যতা,ডেডলাইন ইত্যাদি ওয়েবসাইটেই দেয়া থাকবে । ৫। ইংরেজী ভাষার দক্ষতা : জার্মানিতে আসতে হলে অবশ্যই IELTS দেয়া লাগবে ।। সেই ক্ষেত্রে স্কোর ৭ এর টার্গেট রাখা ভাল যাতে ৬.৫ এর নিচে স্কোর না নামে এবং কোন ব্যান্ডেই যেন ৬ এর কম না হয় । IELTS এর ভয়ে অনেকের বাইরে আসার স্বপ্ন শেষ হয় যায় । আসলে একটু একটু করে কয়েকমাস প্রস্তুতি নিলে IELTS এর বাঁধাটি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারবেন । আমি হঠাৎ করে দিয়ে একবার পুরাই ধরা, ২০ দিনের মাথায় আবারও দিলাম । তাই অযথা টাকা নষ্ট না করে একবারে ঝামেলা শেষ করলে ভাল । কিছু জায়গায় TOEFL গ্রহন করবে আবার স্পেশাল কিছু বিষয়ের জন্য GRE আবদার করতে পারে তাই বুঝে শুনেই বিষয় বাছাই করবেন । ৬। মোটিভেশন লেটার : জার্মানিতে ভর্তির জন্য একটা গুনগান পত্র প্রয়োজন হবে একেই মোটিভেশন লেটার বলে । এই পত্রের মাধ্যমে আপনি মুলত নিজের গুনগান গাইবেন । যিনি এই লেটার পড়বেন তাকে বুঝাইতে হবে আপনি কেন যোগ্য, কেন ভর্তির জন্য আবেদন করছেন, এই শিক্ষা আপনার ভবিষ্যতের জন্য কিভাবে কাজে লাগবে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন পড়তে চান , জার্মানিতেই কেন আসবে ইত্যাদি। আপনার অতীত অভিজ্ঞতা/পুরষ্কার ইত্যাদি বলতে পারেন। উপরোক্ত বিষয় গুলো লিখার সময় অবশ্যই আপনার সামঞ্জস্যপূর্ণ ক্যারিয়ার পরিল্পনার কথা উল্লেখ করা উচিত । মোটিভেশন লেটার সাধারণত ২ পৃষ্ঠার মধ্যেই লিখতে হয়, কখনো ১ পৃষ্ঠা যথেষ্ট । সবশেষে, কোনোভাবেই কপি পেষ্ট করবেন না, ধরা পড়লে আপনার আবেদনই বাতিল হয়ে যেতে পারে । ৭। রিকমেন্ডশন লেটার: অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে রিকমেন্ডশন লেটার চাইতে পারে । এটি হল আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনাকে চেনে জানে এমন শিক্ষকের সুপারিশ পত্র । আপনার ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান, আপনার প্রজেক্ট কিংবা থিসিস সুপারভাইজার অথবা অন্য যে কোন শিক্ষক ( Professor/ Associate Professor হলে ভাল ) হতে এটি সংগ্রহ করতে পারেন যেখানে আপনার যোগ্যতা,দক্ষতা অথবা ভালদিক গুলো উল্লেখ থাকবে সেইসাথে আপনার সীমাবদ্ধও লিখা যেতে পারে । খেয়াল রাখতে হবে এটি পড়ে যেন মনে না হয় কপিপেস্ট করেছেন অথবা যেন মনে না হয় আপনার প্রোফেসর আপনাকে না জেনেই প্রসংসাপত্র দিয়েছেন। রিকমেন্ডশন লেটার সাধারণত ২/৩টি যথেষ্ট । ৮। পাবলিকেশন ও অন্যান্য : এই বিষয়টা খুব বেশী তাৎপর্যপূর্ণ না হলেও প্রতিযোগিতায় আপনাকে অনেক খানি এগিয়ে রাখবে। সায়েন্টিফিক পাবলিকেশন খুব বেশী দরকার। অনার্সের ৩য় বর্ষ থেকে যদি কোন রিসার্চের সাথে সংযুক্ত হওয়া যায় তবে পাশ করার আগেই দু-একটি পাবলিকেশন হয়ে যেতে পারে। এছাড়া যেকোন ধরনের পুরষ্কার, ভলান্টিয়ার অভিজ্ঞতা, সায়েন্টিফিক সেমিনারে অংশগ্রহন ইত্যাদি আপনার সিভি (Curriculum Vitae/RESUME) কে বেশ চমকপ্রদ করবে এবং অন্য প্রতিযোগী হতে আপনি বেশ এগিয়ে থাকবেন। যাদের cGPA একটু কম তাদের জন্য ভাল IELTS এর পাশাপাশি এইসবই প্লাস পয়েন্ট । উপরের সবকিছু মিলিয়ে একটা আকর্ষনীয় CV বানাতে হবে ।। বেশ সময় নিয়ে নিজে তৈরী করবেন এবং পরে সিনিয়র কাউকে দিয়ে রিভিউ করিয়ে নিন। অলসতা করে ইন্টারনেটের ফরমেটে নিজের নাম বসিয়ে কাজ সেরে ফেলবেন না । মনে রাখবেন, শর্টকাট মানেই বিপদ। ৯ । সঠিক তথ্য ও সঠিক পরিকল্পনা : এটি আপনার অন্য সব কিছুকে মুল্যায়ন করবে। যেখানে আবেদন করবেন তার রিকোয়ারমেন্টস ভাল করে বুঝে নিন, ডেডলাইন ডাবল চেক করুন, কোন ডকুমেন্ট কেমন করে চাইছে অর্থাৎ নোটারি কিংবা অন্য কোন রকম সত্যায়ন দরকার আছে কিনা ভাল করে দেখে নিন । এপ্লাই করার পদ্ধতিও বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে আলাদা, সেটিও মাথায় রাখতে হবে। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি আবেদন করা যায় কোথাও আবার Uni-assist এর মাধ্যমে এপ্লাই করা। এছাড়া ভিসার জন্য আবেদন করা, ভিসা পাওয়া, এবং জার্মানিতে আসা অর্থাৎ পুরো প্রক্রিয়ায় অনেক কাজ করা প্রয়োজন তাই প্রতিটি কাজই পরিকল্পনা করে করবেন, সরকারী ছুটির দিন মাথায় রাখবেন। যেকোন কনফিউশন থাকলে অবশ্যই পরিচিত যারা জার্মানি গিয়েছে তাদের কাছে জানতে চান, ফেইসবুকে এই সংক্রান্ত গ্রুপ আছে ঐখানে জিজ্ঞেস করুন । সবাই আপনাকে সর্বাত্নক সহযোগিতা করবে। সিনিয়রদের কাছে আমি নিজেও অনেক কৃতজ্ঞ, ওনারা না থাকলে কত ঝামেলায় পড়তাম উপর ওয়ালা জানেন। ১০। প্রবল ধৈর্য্য !! হেরে যাওয়া যাবে না। পুরো পথে ছোট খাটো অনেক সমস্যা আসবে, কোনো কিছুতেই থেমে যাওয়া যাবে না । মনে রাখবেন, আপনি জার্মান সরকারের টাকায় উচ্চশিক্ষা গ্রহন করতে আসবেন,বাপের টাকায় নয়। তাই চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে জামার্নিতে পা রাখার আগ পর্যন্ত। রেস্টুরেন্টে প্রিয় মানুষের জন্য যেভাবে অপেক্ষা করেন তেমন করেই প্রবল ধৈর্য্য ও অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করুন প্রথমে অ্যাডমিশন লেটার এবং পরে ভিসার জন্য। এরপরেই ডয়েচল্যান্ডের টিকেট ।
এডমিশন লেটার পেয়ে গেলে কাজ অনেকখানি শেষ, এরপর ভিসার আবেদন। জার্মানিতে ভিসা পেতে হলে অন্যান্য কাগজপত্রের সাথে অন্যতম প্রধান শর্ত হলো “ব্লক একাউন্ট” । জার্মানিতে আসার আগেই জার্মানির একটি ব্যাংকে ৮০৪০ ইউরো ( বাংলাদেশী টাকায় ৭ লক্ষের একটু বেশী ) ব্লক করতে হয় । এটি আসলে সিকুরিটি মানির মতই অর্থাৎ জামার্নিতে এসে নিজের থাকা খাওয়া খরচ মিটানোর মত টাকা আছে এমন প্রমাণ । এই একাউন্ট থেকে আপনি প্রতি মাসে ৬৭০ ইউরো তুলতে পারবেন এবং এক বছর পর পুরো টাকাই দেশে পাঠিয়ে দিতে পারবেন ( খরচ না করলে) । কোনো কারণে জার্মানি আসতে পারলে চিন্তার কারণ নেই, এই টাকা জার্মান ব্যাংক আপনার কাছে পাঠিয়ে দেবে ।
- কেমন খরচ পড়বে?: আগেই বলেছি জার্মানিতে পড়তে কোনো টাকা দেয়া লাগবে না । তবে সেমিস্টার শুরুর আগে বিশ্ববিদ্যালয় অনুযায়ী ১৫০-২৫০ ইউরো পর্যন্ত এনরোলমেন্ট ফি দেয়া লাগে তবে মজাটা হলো এই ফি এর বিনিময়ে আপনাকে একটা কার্ড দিবে যেটা দিয়ে আপনি পুরো স্টেটে( কোথাও কিছু শহর) ফ্রি যাতায়াত করতে পারবেন । এর মানে এইখানে গাড়ী ভাড়ার কোনো খরচ নেই। এছাড়া প্রতিমাসে হেলথ ইস্যুরেন্সের জন্য টাকা দিতে হবে এবং জার্মানীতে থাকা পর্যন্ত সকল চিকিৎসা ব্যয় ওরাই বহন করবে অর্থাৎ স্বাস্হ্য নিয়ে চিন্তা না করলেও চলবে । থাকা খাওয়া, বাসা ভাড়া শহর অনুসারে ভিন্ন (যেমন ঢাকা-চট্টগ্রামের জীবনধারন খরচ যশোর-মাগুরার জীবনধারনের খরচ অপেক্ষা বেশী)। তবে সব খরচ যোগ করলে বড় শহরে ৫০০/৬০০ ইউরো এবং ছোট শহরে ৪০০/৫০০ ইউরোর বেশী লাগবে না । আপনার খরচ আপনার লাইফস্টাইলের উপর ; অনেকে ৪০০ ইউরো দিয়েই এইখানে স্বাচ্ছন্দে বাস করছে। (বলে রাখা উচিত বর্তমানে ১ ইউরো = প্রায় ৯০ টাকা) · স্কলারশিপ ও ফান্ডিং কি আছে ? টাকা কিভাবে যোগাড় হবে? : জার্মানিতে আসার জন্য যেদুটি স্কলারশিপ আছে আছে তা হলো DAAD ও Erasmus Mundus স্কলারশীপ । যতটুকু জানি DAAD এর জন্য আপনাকে অবশ্যই চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে । Erasmus Mundus এর ব্যাপারে ইন্টারনেটে খোজঁ নিতে পারেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় হতে অল্প কিছু স্কলারশীপ দেয়া হয়; ২য় সেমিস্টার হতে আবেদন করা যায় এসব ফান্ডিং এর জন্য। এইখানে রিচার্স এসিসন্টেটশীপেরও সুযোগ আছে যা মাস্টার্সেও পেতে পারেন তবে পি এইচ ডি লেভেলে সবার্ধিক। পড়াশুনা করা অবস্হায় এইখানে চাকুরি করার অনুমতি মিলবে। আপনি ছুটির দিনে অনায়াসে কাজ করতে পারবেন , পুরো দিন চাকুরি করলে আপনি পাবেন বছরে ১২০ দিনের অনুমতি, হাফ দিনের ক্ষেত্রে ২৪০ দিন । পার্টটাইম চাকরি করে নিজের খরচ নিজে বহন করে বিয়ের জন্যও কিছু জমিয়ে টাকা রাখা সম্ভব । এখন প্রশ্ন হলো চাকরি পাবো তো ? চাকরির পাবার ক্ষেত্রেও বলতে হয় শহরের ভুমিকা বেশ উল্লেখযোগ্য অর্থাৎ বড় শহরে চাকরি যতটা সহজে পাওয়া যাবে ছোট শহরে ততটা নয় । পড়াশুনা বুঝে উঠে, নতুন জায়গায় অভ্যস্ত হওয়া, ভাষাগত ব্যাপার, সব মিলিয়ে অনেকে এক মাসেও পায় অনেকে ছয় মাসেও নয় । তবে সিনিয়রা বলেন প্রথম ছয় মাস চাকরি না করে পড়াশুনায় মন দেয়াটাই উত্তম । তাই অন্তত প্রথম চারমাসে নিজের পকেট হতে খরচের মানসিকতা রাখাই ভাল । আমার উপদেশ থাকবে জার্মানি আসবেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে প্রাথমিক জার্মান ভাষা শিখে আসবেন । এটি আপনাকে সব জায়গায় অনেকখানি এগিয়ে রাখবে।
এই হলো জার্মানিতে আসার আদ্যোপান্ত । সবকিছু ঠিক থাকলে এবার নেমে পড়ুন কোমর বেঁধে । এই লিখা পড়ে কেউ উপকৃত হলে ধন্যবাদ দেয়ার দরকার নেই, জার্মানি আসার সময় এক প্যাকেট বিরানী আর কিছু ফুচকা-পিয়াজুঁ নিয়ে আসলেই হবে ;অনেকদিন খাইনি!
একটি কথা বলাবাহুল্য,পুরো পৃথিবীতে ইন্ডিয়ান এবং চাইনিজরা ছড়িয়ে গেছে। এরাই ভবিষ্যত পৃথিবীর গুরুত্বণর্পূ জায়গা দখল করে নিবে। বিলিভ ইট অর নট, এরা যে যোগ্যতায় আমাদের চেয়ে অনেক বেশী এগিয়ে,তা কিন্তু নয়! কম আত্নবিশ্বাস, পরিশ্রমবিমুখতা ও হোমসিকনেসের কারণে আমরা পিছিয়ে পড়ছি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ১টি সিটের জন্য ১০০জন পরীক্ষা দিচ্ছি এবং একটি চাকরির জন্য ৫০০ জন্য আবেদন করছি। তাই নিজের যেটুকু যোগ্যতা আছে তা কাজে লাগিয়ে স্বপ্নের ঘুড়ি আকাশে ভাসিয়ে দিতে পারলেই বাংলাদেশীরা পারবে আগামী বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নিতে। সবশেষে, লাল সবুজের পতাকা উড়ুক পৃথিবীর সকল দেশে, বাঙালিদের পদধুলী ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বের আনাচে কানাচে, জয় হোক সকল স্বপ্নবিলাসী শিক্ষার্থীর! ওয়েলকাম টু ডয়েচল্যান্ড !!
Written By Rabiul H Chowdhury·
Masters in Chemistry. Department of Chemistry and Biology.
University of Siegen. Siegen, Germany.
For any inquiry: rabiul_nh_ctg@yahoo.com